বাংলাদেশে পরিবেশের বৈচিত্র্যতা আছে। পরিবেশের এ বিচিত্রতা শুধু অঞ্চলভিত্তিক নয়, এর বিস্তৃতি উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়েও বিদ্যমান। ভূমির উত্তম ব্যবহার এবং কৃষির সঠিক পরিকল্পনার জন্য ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল এবং ৮৮ উপ-অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই মাটির পুষ্টি উপাদান সব জায়গায় এক রকম নয়। এজন্য মাটি পরীক্ষা করে সার দেয়া উপকারী। আমাদের দেশের চাষাবাদ কৌশল, আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং বিভিন্ন পারিপার্শি¦ক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায় আমাদের দেশের মাটিতে পুষ্টি উপাদান দিন দিন কমছে। আর এ অসুবিধা দূর করার জন্য পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সারের অপচয় রোধ তথা পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় ফসলের চাহিদাভিত্তিক সার প্রয়োগ করতে হবে সাথে সাথে গুঁড়া ইউরিয়া সারের বদলে গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহার করা প্রয়োজন। সুষম সার ব্যবহার বলতে বোঝায় মাটির উর্বরতা মান অনুসারে ও ফসলের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ। গাছের পাতার রঙ দেখে সার দেয়া (এলসিসি ব্যবহার) এবং জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার প্রয়োগ করাও প্রয়োজন। সাথে ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটিতে মেশানো, ডালজাতীয় ফসলের চাষ করা, সবুজ সার ফসলের চাষ ও জমিতে মেশানো, কিস্তিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাবার খাওয়া প্রয়োজন তেমনি সব গাছের খাবারের প্রয়োজন হয়। গাছের জন্য যেসব খাবারের প্রয়োজন হয় তার মধ্যে কিছু গাছ নিজেই তৈরি করতে পারে। বাকিগুলো মূলের সাহায্যে মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন আলোর উপস্থিতিতে গাছ বায়ু হতে কার্বন-ডাই অক্সাইড সংগ্রহ করে পানির সাহায্যে খাদ্য তৈরি করে। ক্রমাগতহারে ফসল চাষ করার ফলে মাটি হতে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো আস্তে আস্তে কমে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে ফসলের খাবার জোগান দেয়ার জন্য জমিতে কৃত্রিম উপায়ে খাবার দেয়া দরকার। কৃত্রিম উপায়ে গাছে যেসব খাবার দেয়া হয় তাকেই গাছের পুষ্টি উপাদান বলে। মাটিতে পুষ্টি উপাদান না দিলে গাছ পুষ্টি পাবে না ও ফসল ভালো হবেনা আর এতে গাছের বাড় বাড়তি কমে যাবে তেমনি বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণ হবে। আর পুষ্টি উপাদান জমি থেকে নিঃশেষ হয়ে গেলে পুষ্টি উপাদান পূরণ করা কঠিন হবে। আর ফসলে পুষ্টি ঘাটতি থাকলে তা মানুষ, পশুপাখি সবার পুষ্টি ঘাটতি হবে।
মাটি পরীক্ষার সুফল
মাটিতে পুষ্টি উপাদানের সঠিক অবস্থা জানা থাকলে প্রয়োজন মাফিক সার সরবরাহ করা যায়। অধিক সার প্রয়োগে আর্থিক লোকসানের ঝুঁকি থাকে। আর কোনো পুষ্টি উপাদান বেশি দিলে মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য বজায় থাকে না ফলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে না। বেশি পরিমাণ রাসায়নিক সার দিলে পরিবেশ দূষিত হয় এবং ফলনও কম হয়।
মাটির নমুনা এবং সংগ্রহে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি
মাটির নমুনা হলো কোনো জমি থেকে সংগৃহীত কিছু পরিমাণ মাটি যা ওই জমির মাটির গুণাবলির প্রতিনিধিত্ব করে। সাধারণত একখ- জমির কর্ষণ স্তর বা উপরিস্তর থেকে সমদূরত্বে ৯টি স্থান থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। মাটির নমুনা সংগ্রহের যেসব উপকরণ প্রয়োজন হয় তাহলো-কোদাল/খন্তা/নিড়ানি/বেলচা/অগার। এর সাথে প্লাস্টিকের বালতি/গামলা/পলিথিন শিট লাগবে মাটি আনার জন্য। আর লাগবে মোটা পলিব্যাগ ও সুতলি এবং লেবেল বা ট্যাগ।
জমি থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহের নিয়ম
জমির চার সীমানা থেকে ২-৩ মিটার বা ৪-৬ হাত ভেতরে সমান্তরালভাবে সমদূরত্ব বজায় রেখে ৯টি স্থান থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
রাস্তা বা বাঁধের পরিত্যক্ত ইটের ভাটা/নিকটবর্তী স্থান/সদ্য সার দেয়া জমি/গোবর বা কম্পোস্ট/আবর্জনা স্তূপকৃত জায়গা/ফসলের নাড়া পোড়ানোর জায়গা থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা যাবে না। উল্লেখ্য, মাটির এরকম একটি খ-/প্লট হতেই নিতে হবে।
একাধিক খণ্ড/প্লটের মাটির নমুনা পরীক্ষা করাতে হলে প্রতি খ- জমি হতে আলাদাভাবে মাটির মিশ্র নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
মাটি সংগ্রহের আগে জমির এক স্থানে গর্ত করে কর্ষণ স্তরের গভীরতা দেখে নিতে হবে। সাধারণত রোপা ধানের জমিতে কর্ষণ স্তরের নিচে শক্ত ‘কর্ষণ তল’ থাকে। তাই নমুনা সংগ্রহকালে কর্ষণতল বাদ যাবে।
কর্ষণ স্তরের গভীরতা জানার পর জমির আয়তনমতো জমির ৯টি স্থান চিহ্নত করতে হবে।
পরিষ্কার কোদাল বা খন্তা বা যে কোনো খনন যন্ত্রের সাহায্যে কর্ষণ স্তরের গভীরতা পর্যন্ত আকৃতির গর্ত করতে হবে।
গর্তের এক পাশ থেকে ৪ আঙুল পরিমাণ পুরু মাটির চাকা তুলে চাকাটির দুই পাশ এবং কর্ষণ তলের অংশ (যদি থাকে) কেটে বাদ দিয়ে চাকাটি পলিথিন শিটের ওপর কিংবা প্লাস্টিক বালতিতে রাখতে হবে।
একইভাবে ৯টি স্থান থেকে সংগৃহীত একই পরিমাণ মাটি বালতিতে রাখতে হবে।
চাষ দেয়া জমি থেকে মাটি এমনভাবে নিতে হবে যাতে ঢেলাযুক্ত, গুঁড়া কর্ষণ স্তরের সম্পূর্ণ অংশই সমপরিমাণে সংগ্রহ করা হয়।
সংগৃহীত মাটির নমুনা ভালোভাবে মিশ্রিতকরণ
পরিষ্কার পলিথিন শিট কিংবা বালতিতে রাখা সংগৃহীত মাটির নমুনার চাকাগুলো পরিষ্কার হাতে গুঁড়া করে ভালোভাবে মেশাতে হবে।
মেশানোর সময় মাটিতে ঘাস বা শিকড় থাকলে ফেলে দিতে হবে।
মেশানো মাটি সমান চার ভাগ করে দুইকোন থেকে দুইভাগ ফেলে দিতে হবে। বাকি দুইভাগ মাটি আবার মিশিয়ে তা থেকে ৫০০-৭৫০ গ্রাম পরিমাণ গুঁড়া মাটি পলিথিন ব্যাগে রাখতে হবে।
মাটি ভেজা কিংবা আর্দ্র থাকলে ছায়াযুক্ত স্থানে শুকিয়ে নিতে হবে।
ভেজা মাটির ক্ষেত্রে মাটির পরিমাণ এমনভাবে নিতে হবে যাতে শুকালে মাটি মোটামুটি ৫০০ গ্রাম থাকে।
এ ৫০০ গ্রাম পরিমাণ মাটি পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ঠ উপসহকারী কৃষি অফিসারের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে মাটি পরীক্ষা করাতে হবে অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে মাটি পরীক্ষার নমুনা পাঠিয়ে মাটি পরীক্ষা করাতে হবে।
মাটি পরীক্ষা কোথায় করা যায়
সরকারি ও বেসরকারি প্রায় ৬টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সার সুপারিশ প্রদান করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ঢাকা প্রধান অফিসসহ সব আঞ্চলিক অফিসগুলো, ব্র্যাক, প্রশিকা, জিকেএফ এবং বিএফএ। এছাড়া মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগার রয়েছে।
লবণ প্রয়োগের কুফল
ফসলের অধিক ফলনের আশায় অন্যান্য সার ব্যাবহারের পাশাপাশি জমিতে খাওয়ার লবণ প্রয়োগ করা মোটেও ঠিক নয়। যা ফসল উৎপাদনে কোনো উপকার করে না বরং মারাত্মক ক্ষতি করে। খাওয়ার লবণ সোডিয়াম এবং ক্লোরিন দ্বারা গঠিত মাটিতে এগুলোর পরিমাণ বেড়ে গেলে মাটিতে বিষাক্ততা দেখা দেয়। খাওয়ার লবণ জমিতে দিলে সাময়িক কিছু ভালো ফলাফল দেখা গেলেও তা জমির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং জমিকে অনুর্বর করে তোলে। মাটিতে খাওয়ার লবণ প্রয়োগ করলে যেসব ক্ষতি হয় তা হলো
মাটিতে পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান থাকলেও গাছ তা ব্যবহার করতে পারে না। এটি গাছের জন্য অত্যবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান ফসফরাস ও পটাশিয়ামকে গাছের ব্যবহার উপযোগী হতে দেয় না। অর্থাৎ আমরা টিএসপি বা ডিএপি সার বা এমওপি সার ব্যবহার করলেও লবণ প্রয়োগের জন্য কোনো উপকার পাওয়া যাবে না।
এছাড়া একটু লক্ষ্য করলেই আমরা বুঝতে পারি। সমুদ্রের পানি হচ্ছে লবণাক্ত এটি থেকেই আমরা খাওয়ার লবণ পাই। এ পানির কারণে খুলনা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরিশাল, বরগুনা জেলার মাঠ ফসলের উৎপাদন উত্তরাঞ্চলের অঞ্চলের থেকে কম। অর্থাৎ লবণাক্ততা মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয় আর আমরা যদি এ লবণ মাটিতে প্রয়োগ করি তবে আমাদের মাটিও লবণাক্ত হবে এবং ফসল উৎপাদন কমিয়ে দিবে।
এছাড়াও গাছ মাটি থেকে পানি গ্রহণ করতে পারবে না কারণ লবণের সোডিয়াম ও ক্লোরিন গাছের পানি নেয়ার প্রক্রিয়া অর্থাৎ অভিশ্রবণ প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে ফসল কম হবে ।
খাওয়ার লবণের কারণে কচি শিকড়ের মুখ পুড়ে যায়। কারণ লবণ মাটিতে ক্ষারীয় অবস্থা সৃষ্টি করে। আর এ কারণে শিকড় দিয়ে গাছ পুষ্টি নিতে পারে না ফলে গাছের রোগ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া কচি শিকড়ের মুখ পুড়ে যাওয়ার কারণে গাছের শিকড়ের বিস্তার কমে যায় এবং গাছ হলুদ হয়ে যায়।
মাটির উপকারী অনুজীব নষ্ট হয়, যার ফলে মাটি তার স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না।
খাওয়ার লবণের কারণে গাছের ভেতরের প্রয়োজনীয় রস শিকড় দিয়ে মাটিতে চলে যায়। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে মারা যায়। কারণ লবণ প্রয়োগ করলে গাছের মধ্যকার রসের ঘনত্বের চেয়ে মাটির মধ্যকার পানির ঘনত্ব বেড়ে যায় ফলে গাছের রস মাটির পানিতে চলে আসে।
লবণ প্রয়োগ করলে ইউরিয়া সার, টিএসপি সার, দস্তা সার প্রয়োগ করলেও কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যাবে না।
বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে উৎপাদন ও ফলন উভয়ে কমে যায়।
এছাড়া খাওয়ার লবণ প্রয়োগের কারণে মাটির গঠন ভেঙে যায়। এবং সঠিক মাত্রায় মাটিতে পানিও বাতাস থাকতে পারে না। আর পানি ও বাতাস পরিমাণমতো না থাকলে গাছের শিকড় সঠিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না, গাছ সহজে পানি গ্রহণ করতে পারে না।
মাটির গঠন ভেঙে গেলে মাটি শক্ত হয়ে যায় এবং উৎপাদন বিকল্প প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক অসুবিধা হচ্ছে প্রথমে লবণ ছোলা প্রয়োগ করলে পটাশ সারের গ্রহণ বৃদ্ধি পায় পরে কমতে কমতে এমন পর্যায়ে যায় যে সার প্রয়োগ করলে ও আর গাছ গ্রহণ করতে পারে না।
মাটি গাছের পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে যা গাছের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৫১ সাল থেকে নাইট্রোজেন, ১৯৫৭ সাল থেকে ফসফরাস, ১৯৬০ থেকে পটাশিয়াম, ১৯৮০ সাল থেকে সালফার, ১৯৮২ সাল থেকে দস্তা (জিংক), ১৯৯৫ সাল থেকে বোরন এবং ২০০০ সাল থেকে ম্যাগনেশিয়াম এবং মলিবডেনামের অভাব পরীলক্ষিত হচ্ছে। গাছে ১৬টি পুষ্টি উপাদানরে মধ্যে ১৩টি মাটি থেকে আসে। দীর্ঘদিন শস্য উৎপাদনের ফলে মাটির পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ আর আগের অবস্থায় নেই। এ অবস্থায় মাটির স্বাস্থ্যের জন্য মাটি পরীক্ষা করা এবং জমিতে লবণ প্রয়োগ না করা একান্ত প্রয়োজন।
কৃষিবিদ মো. আবদুল্লাহ-হিল-কাফি*
*আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী